ইসরায়েলের পেছনে উপনিবেশবাদী পশ্চিমা শক্তির ভূমিকা
ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্মের পেছনে উপনিবেশবাদী শক্তিগুলোর প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে। ১৯৪৮ সালে যখন ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পায়, তখন প্রায় ৭ লাখ ফিলিস্তিনি নিজ ভূমি থেকে জোরপূর্বক উৎখাত হন। তারা আশা করেছিলেন, এই সংকট সাময়িক হবে এবং শিগগিরই তারা নিজেদের ঘরে ফিরতে পারবেন। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন ছিল। সেই প্রত্যাবর্তনের পথ আর কখনোই খোলা হয়নি।
ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে যেসব ইহুদি পূর্বে ইউরোপ থেকে ফিলিস্তিনে এসেছিল, তারাই পরে হয়ে ওঠে দখলদার ও নিপীড়ক। বর্তমানে সেই দখলদারিত্ব আরও গভীর হয়েছে, এবং এরই ধারাবাহিকতায় গাজা উপত্যকায় চলছে ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যা। জাতিসংঘ এই অঞ্চলকে শিশুদের জন্য ‘গোরস্থান’ বলে অভিহিত করেছে।
বেলফোর ঘোষণা ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক নীতি
১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড আর্থার বেলফোর একটি চিঠির মাধ্যমে ইহুদি নেতা ব্যারন রটসচাইল্ডকে আশ্বস্ত করেন, ব্রিটেন ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করবে। ইতিহাসে এটি "বেলফোর ঘোষণা" নামে পরিচিত।
তখন ফিলিস্তিনে ইহুদিদের সংখ্যা ছিল খুবই কম, তবে ইউরোপজুড়ে ইহুদিদের প্রতি বৈষম্য ও সহিংসতা এই চাহিদাকে জোরালো করে তোলে। ফিলিস্তিনি আরবদের ঐক্য ও ভূমি অধিকারকে পাশ কাটিয়ে একটি ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
নাৎসি নিপীড়নের পরিণতি: ইহুদি অভিবাসন ও উত্তেজনার সূত্রপাত
১৯৩৩ সালে হিটলার ক্ষমতায় আসার পর জার্মানিতে ইহুদিদের ওপর নির্যাতন বাড়ে। হাজার হাজার ইহুদি ফিলিস্তিনে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয়। ফিলিস্তিনিরা এ প্রবাহে নিজেদের অস্তিত্ব বিপন্ন মনে করে বিদ্রোহ শুরু করে। কিন্তু ব্রিটিশ বাহিনী সেই বিদ্রোহ দমন করে, ফলে আরব সমাজে বিভক্তি তৈরি হয়। এই সুযোগে ইহুদিরা নিজেদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগঠিত হতে থাকে।
জাতিসংঘের বিভাজন প্রস্তাব ও ইসরায়েলের জন্ম
১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে দুটি রাষ্ট্রে ভাগ করার প্রস্তাব দেয়—একটি ইহুদি ও একটি আরব রাষ্ট্র। যদিও ইহুদিরা কেবল ১০% জমির মালিক ছিল, তবু তাদের ৫৫% জমি দেওয়া হয়। আরবরা এই পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে, কিন্তু ইহুদিরা উল্লাসে মেতে ওঠে। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষণা করা হয়।
POP
১৯৪৮-এর আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ ও ‘নাকবা’
ইসরায়েলের ঘোষণার এক ঘণ্টার মধ্যেই মিশর, জর্ডান, সিরিয়া, লেবানন ও ইরাক ইসরায়েল আক্রমণ করে। কিন্তু আরব বাহিনীর মধ্যে নেতৃত্বের অভাব, সমন্বয়হীনতা ও পারস্পরিক অবিশ্বাস তাদের দুর্বল করে তোলে। বিপরীতে, ইহুদি বাহিনী ছিল সুসংগঠিত ও আন্তর্জাতিক সমর্থনপুষ্ট।
এই যুদ্ধে ইসরায়েল একের পর এক ফিলিস্তিনি গ্রাম দখল করে এবং প্রায় ৭ লাখ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হন, যাকে ফিলিস্তিনিরা ‘নাকবা’ (মহাবিপর্যয়) নামে স্মরণ করে।
বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘ দুর্দশা
৭ লাখ বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনির সংখ্যা এখন প্রায় ৭০ লাখ। তারা আজো বিশ্বের নানা প্রান্তে, বিশেষ করে গাজা, পশ্চিম তীর, জর্ডান, লেবানন ও সিরিয়ায় বসবাস করছেন শরণার্থী শিবিরে। এদের অধিকাংশের নেই নাগরিকত্ব, মৌলিক অধিকার কিংবা স্বদেশে ফেরার নিশ্চয়তা।
গাজার বাসিন্দাদের প্রায় সবাইই সেই উচ্ছেদ হওয়া পরিবারগুলোর পরবর্তী প্রজন্ম। সেখানে মানবিক সংকট আজ ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নিরাপত্তা, খাদ্য—সবকিছুই ঘাটতির মধ্যে রয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি অবরোধ, বোমাবর্ষণ ও অনিশ্চয়তা ফিলিস্তিনিদের জীবনকে বন্দিত্বে পরিণত করেছে।
ইতিহাসের শিক্ষা: রাষ্ট্রবিহীন জাতির স্বপ্ন থাকে না
ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা একদিকে এক পক্ষের জন্য বিজয়ের গল্প, অন্যদিকে ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি দীর্ঘ ও চলমান ক্ষতির ইতিহাস। রাষ্ট্রহীন জাতি শুধু নিরাপত্তা নয়, হারায় তাদের স্বপ্ন, অধিকার ও ভবিষ্যৎ।

0 মন্তব্যসমূহ